আঁখি জলে ভাসি-০৩

লিখেছেন লিখেছেন Saidul Karim ০২ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৮:০৭:১৯ রাত

কুহু কুহু করে একটা পাখি অনেক ক্ষণ ডাকছে।এখন আর সে পাখিটির ডাক শুনা যাচ্ছে না।মায়ের মুখে শুনেছি,যে বাড়ির আঙ্গিনায় এই পাখি ডাকে সে বাড়ির কোনো কুটুম্বের অকল্যাণ হয়।

মাঝে মাঝে এই কুহু পাখির ডাক আমাদেরকে অদৃশ্য জগতের শঙ্কায় তাড়িত করে।মনে পড়ে আমার আব্বার নিরবে চলে যাওয়া।তিনি আমাকে শিখিয়েছেন অর্জিত সম্পদের মূল্যায়নের কথা,আত্ম-সম্মানও চিরন্তন মূল্যবোধের পরিচয়।

আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, যখন আমি কুরআনের পনের খন্ড মুখস্থ করেছি তখন একদিন দর্জির দোকানে গিয়েছিলাম পাঞ্জাবী সেলাই করবো বলে।শিক্ষকের কঠোর নিষেধাজ্ঞা-'এমব্রয়ডারি করে পাঞ্জাবী পরিধান করা যাবেনা'।কেননা,এটি হারাম! বিলকুল হারাম! দোকানদার বিভিন্ন কাপড় দেখানোর পর একটা হাতে নিয়ে আব্বাকে বললেন;'চাচা এটা নেন,দাম প্রতি গজ সত্তর টাকা মাত্র। ও (আমি) এখনো অনেক ছোট এত বেশি দামমী কাপড় দেওয়ার দরকার নেই'।আব্বা বললেন,'তুমিকি জান? ও যে পবিত্র কুরআনের পনের খন্ড তথা অর্ধেকের হাফেজ। ওকে এর চেয়ে তিনগুণ দামী কাপড় দিতে হবে'।তিনি তাই দিয়েছিলেনও।কেন দেবেন না।আমি যে তাঁর চৌদ্দ বছরের অশ্রুশিক্ত প্রার্থনার ফসল আমি ভূমিষ্ঠপূর্বে কোনো একদিন পবিত্র কা'বা ঘরের গিলাফ ধরে তিনি নাকি দোয়া করেছিলেন; হে আল্লাহ! উচ্চ্বাসিত যৌবনটা কাটিয়েছি ভ্রষ্টতায়,বিচারদিবসে মুক্তির জন্য কিছু করেনি।যদি আর একটি সন্তান দাও তাকে আমি 'হাফিজুল কুরআন' করবো।

২০০৪ সালের ৮ই জুন তাকে ফিরিয়া আনা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল থেকে।তাঁর পাকস্থলীর ক্যান্সার! এখন আমি যে রুমে শুই আব্বাকেও সেই রুমে রাখা হয়েছে,পূর্ব-পশ্চিম ভাবে।আমি তখন কুরআনের ছাব্বিশ পারা মুখস্থ করেছি।বেলা ২টার দিকে হাফেজখানা থেকে আসলাম তাকে দেখার জন্য।আব্বা আমাকে ইশারা করে ডাকলে তাঁর শিয়রে গিয়ে বসি।তিনি আমাকে তাঁর মুখখানি আমার মুখে লাগিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন কিছুক্ষণ।এই আলিঙ্গন সাধারণ আবেগ তাড়িত নয়;এটি হল কিরণ বিচ্ছুরিত মানিককে চিরতরে ছেড়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি ও বিদায়ী আত্মার হৃদয়ে পুঞ্জীভূত ভালবাসা ও স্নেহের সমাপনী ছোঁয়া। তারপর আমার কানে কানে বললেন; বাবা! আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারেনি।তোমাকে আল্লাহর নিকট আমানত রাখবো।দুনিয়ার কারো কাছে নয়। তাঁর রুগ্ন ভগ্ন কন্ঠস্বর আমার হৃদয় কুঠিরে আঘাত হানলো বজ্রপাতের মত। মনে হলো একটি ভারী পাথর খন্ড আমার বুকেত ওপর ভর করছে।লোকচক্ষুর অন্তরালে গড়িয়ে পড়ল বেদনার নীল অশ্রু।

আহ! যে মানুষটির গর্জনে সারাবাড়ি ভরি নিস্তব্দতা নেমে আসতো আজ তাকেই অক্ষমতা গ্রাস করে ফেলছে! শুয়ে আছে নিরবে চির শান্ত সকালের শিশিরের মত।সেদিন আব্বাকে দেখতে আসা রুম ভর্তি মানুষের সামনে আমাকে তাঁর এহেন আদরে লজ্জিত হয়েছিলাম কিন্তু,আজ তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে তাড়িত করে।কাটে বিনিদ্র রজনী।নিরবে কাঁদে মন।চিত্তের নব পর্দায় আঘাত হানে তাঁর সেই উক্তি;মনে পড়ে তাঁর নিভৃতে ধ্যানমগ্ন হওয়া।

রাত অনেক গড়িয়েছে।সপ্তর্ষীমন্ডল ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে।চাঁদের সেই কিঞ্চিৎ আলো দখল করছে রুমের অর্ধেক যায়গা।দূর মসজীদ থেকে ভেসে আসছে সু-মধুর সুর-'আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম'।এখনো জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি।এমনি করে অনেক রাত কেটে যায়,চাঁদের সাথে ভাব জমিয়ে কিংবা আলো আধাঁরির সাথে স্বপ্ন সাজিয়ে।ভাবি,আমার যেসকল সহপাঠিরা পেছনের বেঞ্চে ছিল তারা আজ অঢেল বিত্তের মালিক।কিন্তু,আমরা যারা সামনের বেঞ্চে ছিলাম তারা এখনো সেই স্থানের একটু পেছনে,বই-খাতা কলম নিয়ে বকলম হয়ে।না পারি কাজ করতে না পারি কাজ দিতে।তবু ছেড়ে যাওয়া সাথীদের অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করি।অনবরত প্রতিক্ষার প্রহর গুনি হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের আরেকটি বার উচ্চ্বাসিত আলিঙ্গন ও মিলনের।

পুরো লিখা: http://www.bdfirst.net/blog/blogdetail/detail/11163/Saidul%20Karim/72784#.VofZqjN-6zM

বিষয়: সাহিত্য

১১৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File